লেখক: মেহেদী হাসান শুভ্র গাজী:
ছোটবেলা থেকে বাবার কাছে থেকে জেনে এসেছি রাজনীতি, মানবকল্যাণ সাধনার বিষয়। তার জন্য প্রয়োজন নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা, আত্ম-মগ্নতা পড়াশোনা। এতদিন পর এখন মনে হয় ভুল জেনেছি। চারদিকে চোখ মেলে দেখছি রাজনীতি হচ্ছে চামচামি, পা টেপা, দৌড়ঝাপ, পিঠ চুলকানো, সংগঠনে পদ-পদবী পেতে অর্থের বাণিজ্য। আগে জানতাম জনকল্যাণমুখী সমাজিক নেতৃবৃন্দ দলের অসাধারণ কিছু করলে তাদের পোস্ট পদবি মেলে। এখন দেখি হালে যিনি রাজনীতির জগতে এসেছেন তিনি ও পদ-পদবী এমপি মন্ত্রী সভাপতি পুরস্কার হিসেবে পাচ্ছে।
এই পদ-পদবী বা উত্তর উওরীয়র, ছবি, বিলবোর্ড মেইন রাস্তায় তোরণ নির্মাণ করে ফেসবুকে দিচ্ছেন। দেদারছে অভিনন্দন মন্তব্য আর লাইক পড়ছে তাতে। এই রাজনীতিবিদরা মনে করছেন তিনি সত্যিই রাজনীতিবিদ হয়েছেন। কেউ কেউ নামের আগে নেতা জুড়ে দিচ্ছেন, কেউ জুড়ে দিচ্ছেন জনগণের খাদেম। এসব নেতা বা জনপ্রতিনিধির বেশিরভাগই নাকি টাকা দিয়ে কেনা। যাকে নেতা বা জনপ্রতিনিধি বানানো হয় তার কাছ থেকে বেশি চাঁদা নিয়ে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে পদ-পদবী। অনেককে একসঙ্গে দিলে ভালো বাণিজ্য আর সঙ্গে সংগঠনের পদ-পদবী এবং তার কর্ণধারদের নাম প্রচার হয়। পুরস্কার দেওয়ার উসিলায় দেশের নামকরা লোকদের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। তাদের ডাকছেন, তাদের সঙ্গে বসছেন আলাপ করছেন। পরে সেটা কাজে লাগিয়ে বাণিজ্য করছেন। অন্যান্য কাজ হাসিল করে নিচ্ছেন।এরা আবার দেশ চালাক। বিনা চাদায় দু চার জন ভালো প্রবীণ নেতাকে পুরস্কার দিয়ে বিষয়টা জায়েজ ও করে নিচ্ছেন। প্রতিদিন নতুন নতুন নেতা গজাচ্ছে। এদের সংখ্যা অনেক বড় এদের দেখে মনে হয় জ্ঞানী বিজ্ঞানী।
এ অভিরাম পদ-পদবী ব্যবসা শুধু কেন্দ্র কেন্দ্রিক না, চলছে দেশজুড়ে। সারা বছরই বিভিন্ন স্থানে লেগে আছে ওয়ার্ড ইউনিয়ন উপজেলা থানা সম্মেলন। এমন কি প্রত্যন্ত গ্রামে পর্যন্ত। নেতা জনপ্রতিনিধিরা দলবেঁধে ঝাকের কৈ বা পিঁপড়ের সারির মত সেখানে যাচ্ছেন, স্টেজ আলোকিত করে বসছেন বক্তৃতা দিচ্ছেন। এমপি উপজেলা চেয়ারম্যান মেয়র ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের সঙ্গে ছবি তুলে নিজেদেরও বড় মনে করছেন।
আমার প্রশ্ন, এত ছোটাছুটি করলে নেতার জন্য জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়ন ও জনগণের সেবা করবে কখন। উন্নয়ন ও জনসাধারণের জন্য তো সময় দরকার, দরকার নিভুতি, মগ্নতা। জনপ্রতিনিধিরা সময় না পেলে জনগণের কি হবে? শুধু তাই নয়, কোন কোন পাতিনেতা, পা চাটা জনপ্রতিনিধিরা মন্ত্রী, এমপির নাম একসঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট করে। যে কোন একজন বাদ দিয়ে চূড়ান্তভাবে তার কাছে যে যোগ্য ব্যক্তি মনে হয় তাকে বেছে নেয়া উচিৎ।
কুন্ত অযোগ্য নেতাদের নামে পদ-পদবী ঘোষণা করেন। এতে যে নিবেদিত কর্মী ও নবীন প্রবীনদের অসম্মান হয় তা ব্যবসায়ী আয়োজকরা বোঝেন না। আর্চার্য ব্যাপার যাদের নাম বাদ দিয়ে দেওয়া হয় তারা প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন।আমরা কি এতটাই কাঙ্গাল হয়ে গেলাম? যদি মুক্তিযোদ্ধার চেতনার বিশ্বাসে কোন পুরস্কার হয় তার জন্য নিবেদিত নেতার আকাঙ্ক্ষা থাকতেই পারে। সবাই তার প্রাপ্ত কাজের স্বীকৃতি চায়। কিন্তু এসব হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা ও জনপ্রতিনিধিদের এত আকাক্ষা কিসের? এত হ্যাংলামি কিসের? হাপিত্যেশ কিসের?
অনেক সময় ভালো স্বচ্ছ নেতাদের এই কাতার ভুক্ত হতে দেখে কষ্ট পাই। আবার এটাও ভাবি তাদের বা দোষ কি, কেন্দ্র থেকেই গলদ। এখন তৃণমূল থেকে যতই যাচাই করা হয় তার চেয়ে অনেক বেশি বিবেচনায় আসে ব্যক্তিগত পরিচয়, মাখামাখি, লেনাদেনা ইত্যাদি। এসব করতে গিয়ে কেউ কাউকে সোনার চেন দেন কেউ দেন অন্য কিছু। কি কি দেন তার সব কিছু তো আবার বলাও যায়না। লজ্জা বলে তো একটা শব্দ আছে অভিধানে। এতে সত্যিকারের দেশ প্রেমিক রা বাদ পড়ে যাচ্ছেন। প্রতীক্ষায় থাকতে থাকতে অস্থির হয়ে এক সময় তাদেরও মনে হয় এই ছোটাছুটি ধারাধরিই পথ। তাহারা তা করে না, তাদের বড় অংশই রাজনীতি অঙ্গন থেকে বঞ্চিত হয়ে যান।
নেতা তৈরীর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে প্রতিযোগিতার সংখ্যা। এসব প্রতিযোগিতায় বিভিন্ন দল থেকে দলবেঁধে প্রবেশ করছে। এসব মানুষের টাকার অভাব নেই। তারা কিছুটা খরচ করে টাকার ভারও মুক্ত হচ্ছেন, সাংস্কৃতির সঙ্গে নাম ও যুক্ত হচ্ছে। কালোটাকাও খানিকটা জায়েজ হচ্ছে। এমন সুযোগ কে ছাড়ে? এমন ও শুনি স্টেজে বসার জন্য প্রধান অতিথি বিশেষ অতিথি হওয়ার জন্যও অনেক অর্থ দেয়। পা চাটা নেতাদের জন্ম দিন পালনের কালচার দিন দিন ব্যাপ্তি ঘটছে। কখনো কখনো নেতারা নিজেরাই জন্ম দিন পালন করছেন। কোনো নতুন সহযোগী সংগঠনকে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে করচ্ছেন অনুষ্ঠান। জন্মদিন উপলক্ষে নিজের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করছেন। এতে কি লাভ হয় আমার জানা নেই।
হ্যা ফেসবুকের মাধ্যমে কিছু লোক দেখে লাইক কমেন্ট করে এই তো। এর বেশি কি কিছু নয়? তাহলে আমারা মুক্তিযুদ্ধের চেতানায় বিশ্বাসী কেন? এদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ড দেখে কষ্ট পাই, এ বড় বেদনার। এসব রাজনীতিবিদ নিজেরাই নিজেদের পুরস্কার দেয়। এইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশ্বাসের এই চিত্র। কিন্তু সেই মনের সচ্ছ নেতা থাকতে হবে। আছে কি তেমন নেতা? কাটপিজ নেতার ছড়াছড়ি। অথচ দেশ প্রেমিক নেতা তাদের কথা বলার সুযোগ নেই। তাই আর প্রকৃত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন নেতা তো বলবে না, আমাকে সম্মান দাও। সত্যিকার সচ্ছ নেতা প্রতিটা ক্ষেত্রে বঞ্চিত হচ্ছে।
এই ঘোর কলিকালে টিমটিম করে জলছে সততার আদর্শ। তারা এখনো ধরে রেখেছে আদর্শের দীপ শিখাটি। এই যদি হয় অবস্থা সত্যিকার রাজনীতিবিদরা কি করবেন। যতই তারা ভাবেন না কেন, এসব দেখবে না, নিজের মনে লিখে যাব, স্বীকৃতির দরকার নেই। জনগণের স্বীকৃতিই বড় স্বীকৃতি, কিন্তু সমাজ তা ভাবতে দেয় না। তারাও তো সমাজে বাস করেন। চার পাশে যখন এসব ঘটে, পরিবার থেকে যখন বলে, সবাই পায় তুমি পাও না কেন? সবাই কে ডাকে তোমাকে ডাকে না কেন? তুমি বোধ হয় অযোগ্য। তখন সে উপেক্ষায় বুকে বড় আঘাত লাগে! এসব সয়ে লিখে যাবে এমন মনের জোর সবার থাকে না। তাই কিন্তু প্রকৃত দেশ প্রেমিক নেতা হতাশায় নিমজ্জিত হয়। এক সময় ভাবতে থাকেন লিখলে সমস্যা গোড়ায়। কি ভুইফোর নেতা, কি আদর্শ কোথাও নিরপেক্ষতা নেই। (একই গাছের পান শুপারি একই গাছের চুন আল্লাহ মিয়ার গুণ)।
দেশদ্রোহী ব্যক্তিদের বিতাড়িত করলে যোগ্য ব্যক্তি স্থান পাবে। অযোগ্যরাই বেশি নির্বাচিত হয় ধরাধরি করে, তার মাঝে যোগ্যতার ভিত্তিতে যে দু চার জন হন তাদের জোর কপাল। কালোত্তীর্ণ প্রবীন টিকে থাকে তার জন্য ধরাধরি করে মর্যাদার নেওয়ার জন্য প্রয়োজন পড়ে না। বিশ্ব রাজনীতি বটেও এই সোনার বাংলাদেশেও অনেক বড় রাজনীতি বিদ গন্য করা হয়। এমন তারা কোনো মর্যাদা বা পুরস্কার পাননি। পেয়েও প্রত্যাখ্যান করেছেন এমন নজিরও আছে। কিন্তু তাহারা হারিয়ে যাননি। সদর্পে বেচে আছেন হারিয়ে গেছেন তারা যারা ধরে পড়ে লাজ লজ্জা খুইয়ে এমপি মন্ত্রী নিয়েছেন। রাজনীতি নিয়ে এই বেসাতি ভালো লাগে না।
রাজনীতিবীদরা রাষ্ট্রের ও সমাজের বিবেগ। তাদের আদর্শে জনগন অনুপ্রেরণা পাবে। সত্য আদর্শ মিথ্যার তফাত বুঝতে পারবে, আদর্শের পথে হাটবে। সেই সমস্ত রাজনীতিবিদরাই যদি ভুল পথে পা বাড়ান তাহলে সমাজের ভবিষ্যত অন্ধকারে ডুবে যাবে। আদর্শ ও প্রেরনা সৃষ্টি সম্ভব হবে কীভাবে? কাজেই সময় এসেছে আমরা সঠিক পথে অনুসব্ধানের আত্নমর্যাদা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার। সবাই এক হলে দূর হবে এসব অনাচার।
সতাপতি
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড বেলকুচি উপজেলা শাখা, সিরাজগঞ্জ।
Leave a Reply